পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি ও বাঙালি বৈষম্য: কারণ ও প্রতিকার

সাইফুল ইসলাম: বান্দরবান জেলা প্রতিনিধি
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি বিশেষ অঞ্চল যেখানে উপজাতি সম্প্রদায় ও বাঙালিরা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে। এই অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল এবং এখানে উপজাতি ও বাঙালিদের মধ্যে পারস্পরিক বৈষম্যের ইস্যু উল্লেখযোগ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি এবং বাঙালি উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্যের বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। এই লেখনীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান বৈষম্যের প্রকৃতি, এর কারণ, এবং এর প্রতিকার নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো।
বৈষম্যের প্রকৃতি
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি ও বাঙালিদের মধ্যে বৈষম্যের বিষয়টি মূলত সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে উপজাতি সম্প্রদায় নিজেদের অধিকার এবং সংস্কৃতির অবমাননা এবং অবহেলার শিকার বলে মনে করে থাকে, যেখানে বাঙালিরাও নিজেদের উন্নয়ন তথা অধিকার ও চাকরিতে সুবিধাবঞ্চিত বলে দাবি করে। বৈষম্যের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো:
জমি ও ভূমি সংক্রান্ত ইস্যু:
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী উপজাতিদের জমি অধিকারকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্যের জন্ম দেয়। বাঙালিরা পার্বত্য এলাকায় ভূমি কিনতে এবং বসতি স্থাপন করতে ইচ্ছুক হলেও স্থানীয় আইনি প্রক্রিয়া এবং সামাজিক বাধার কারণে তাদের জন্য এ প্রক্রিয়া সহজ নয়। জমির মালিকানা পাওয়ার ক্ষেত্রে উপজাতি জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যা বাঙালিদের জন্য একটি বড় বাধা। উপজাতিরা বিশ্বাস করে যে, ঐতিহ্যগতভাবে তাদের পূর্বপুরুষের জমি তাদেরই মালিকানা হওয়া উচিত। তবে অনেক সময় সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্প এবং বসতির জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যা উপজাতিদের সাথে সংঘর্ষের কারণ হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব:
উপজাতিদের নিজস্ব প্রথাগত শাসন ব্যবস্থা (যেমন সার্কেল চীফ প্রথা) রয়েছে এবং তারা বিশ্বাস করে এই ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। অন্যদিকে, বাঙালিরা অধিকাংশ সময় সরকারি প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করে, যা তাদের প্রতি পক্ষপাতের ধারণা সৃষ্টি করে। এছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি সংসদীয় আসন থেকে বাঙালি জনপ্রতিনিধি থাকে না।
চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্য:
পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিক্ষেত্রে বাঙালি প্রার্থীদের জন্য সুযোগ সীমিত। সরকারি নীতিমালায় উপজাতিদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা থাকার ফলে বাঙালিদের জন্য প্রতিযোগিতার সুযোগ কমে গেছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং এনজিওতে স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়ের সদস্যদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, ফলে সেখানে বাঙালিরা প্রয়োজনীয় মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে এবং বিভিন্ন উপজেলা পরিষদে অধিকাংশ পদই উপজাতি সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকে, যা বাঙালি প্রার্থীদের চাকরির সুযোগকে সীমিত করে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য:
পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতি শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা শিক্ষা অনুদান, বৃত্তি, এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে, যা বাঙালি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের জন্ম দেয়। উপজাতি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কোটার মাধ্যমে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ করা হয়, অথচ বাঙালি শিক্ষার্থীরা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত। একই সাথে, উপজাতিদের জন্য শিক্ষারত্ন, ভাতা এবং সরকারি বিশেষ অনুদান দেওয়া হলেও বাঙালি শিক্ষার্থীরা এ ধরনের কোনও সুবিধা পায় না।
উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য:
সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমে উপজাতি জনগোষ্ঠীকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়। স্থানীয় এনজিও এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোও উপজাতি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বেশি মনোযোগ দেয়। ফলে, বাঙালিরা অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে থাকে। অর্থনৈতিক কার্যক্রম যেমন ঋণ, প্রশিক্ষণ, এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে উপজাতিদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ রয়েছে, যা বাঙালিদের জন্য সীমিত।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য:
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাঙালি সম্প্রদায়কে অনেক সময় সামাজিকভাবে অবহেলা এবং বৈষম্যের শিকার হতে হয়। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে বাঙালিদের অংশগ্রহণ সীমিত করা হয়। এছাড়া, স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণে বাঙালিরা সমাজের মূলধারায় তাদের জায়গা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন না। এ ধরনের বৈষম্য বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে হতাশা এবং সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে।
বৈষম্যের কারণ
পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈষম্যের পিছনে বিভিন্ন কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো হলো:
সংস্কৃতি ও পরিচয়বোধের পার্থক্য:
পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, এবং ধর্মীয় বিশ্বাসে অটল। বাঙালি জনগোষ্ঠী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইসলামের অনুসারী এবং তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আচার-আচরণ ভিন্ন।
রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার:
রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে উপজাতিদের কিছু বিশেষ সুবিধা রয়েছে, যেমন পার্বত্য শান্তি চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্বায়ত্তশাসন। তবে, বাঙালিরা মনে করে, এসব সুবিধা অনেক সময় বাঙালিদের অবমূল্যায়ন এবং অসম অবস্থার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অর্থনৈতিক বৈষম্য:
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে উপজাতি ও বাঙালিদের মধ্যে সুযোগের পার্থক্য রয়েছে। উপজাতি সম্প্রদায় মনে করে যে, সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পগুলো তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না এবং তাদের ভূমি অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আবার বাঙালিরা মনে করে, উপজাতিদের জন্য কিছু বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকায় তারা বৈষম্যের শিকার।
প্রতিকার ও সমাধান
বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য এবং উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষার জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এখানে কয়েকটি প্রতিকারের প্রস্তাবনা দেওয়া হলো:
অবিচার দূরীকরণ এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা:
পার্বত্য অঞ্চলে একটি সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী আইন প্রয়োগকারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা উচিত, যাতে উভয় সম্প্রদায়ের অধিকার সমানভাবে রক্ষা পায়।
স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ:
পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় প্রশাসন এবং জাতিগত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে, যাতে উভয় সম্প্রদায়ের জনগণ তাদের নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
উভয় সম্প্রদায়ের জন্য সমান অর্থনৈতিক সুযোগ:
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকার ও এনজিওগুলোকে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করতে হবে। কর্মসংস্থান, ব্যবসায়িক প্রকল্প, এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে উভয় সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
সাংস্কৃতিক সহনশীলতা বাড়ানো:
উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করা উচিত। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উভয় সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া উচিত।
চাকরিক্ষেত্রে সমতা:
পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি এবং বেসরকারি চাকরিক্ষেত্রে উভয় সম্প্রদায়ের জন্য সমান সুযোগ থাকা প্রয়োজন।
শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তি ও অনুদান:
বাঙালি শিক্ষার্থীদের জন্যও আলাদা বৃত্তি ও শিক্ষা সুবিধা চালু করা যেতে পারে।
ভূমি অধিকারে ন্যায়বিচার:
ভূমি অধিকার সংক্রান্ত নীতিমালায় উভয় সম্প্রদায়ের জন্য সমান সুযোগ রাখা উচিত, যেন বাঙালিরা এই অঞ্চলে তাদের বসতি স্থাপন করতে পারে।
উন্নয়ন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তি:
উন্নয়ন কার্যক্রমে বাঙালিদেরও সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং অর্থনৈতিক সমতা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমতা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বাঙালিদেরও অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বাড়ানো উচিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি ও বাঙালিদের মধ্যে বৈষম্যের বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং সংবেদনশীল। তবে, আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রামে উভয় সম্প্রদায়ের জন্য সমান সুযোগ, অধিকার এবং সম্মান নিশ্চিত করতে সরকার, এনজিও, এবং স্থানীয় প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এইভাবে, শান্তি এবং স্থায়িত্ব আনতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন সম্ভব হবে।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.