♣♣ টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার মাহমুদপুর গণহত্যা দিবস এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে দোকানদারি ♦♦

Zoynal Abedin's Profile Photo, Image may contain: 1 person, eyeglasses and closeupজয়নাল অাবেদীন

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার মাহমুদপুর গণহত্যা দিবস এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে দোকানদারি

নীরবেই চলে গেল টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হাদিরা ইউনিয়নের “মাহমুদপুর গণহত্যা” দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার ও অালবদররা এ নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল। এতে ২৩ জন নিহত এবং ২০/২৫ জন গুরুত্বর অাহত হন। ধর্ষিতা হন বেশ ক’ জন রমনী।

একাত্তরের সেই উত্তাল দিনে দেশজুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। টাঙ্গাইলে শক্ত অবস্থান নেন কাদেরীয়া বাহিনী। এ বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন হুমায়ুন বেঙ্গল। তিনি উত্তর টাঙ্গাইলে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করেন।Image may contain: outdoor

একাত্তরের অাগষ্ট মাসে, গোপালপুর উপজেলার নগদাশিমলার যুদ্ধে, গোপালপুর থানা সদর থেকে অাসা হানাদার বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হুমায়ুন বেঙ্গলের হাতে মার খেয়ে, পশ্চাৎপসরন করেন। এ যুদ্ধে নগদাশিমলা ইউনিয়নের পোড়াবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা, কুখ্যাত রাজাকার গুল মিয়া নিহত হন।

মুক্তিযোদ্ধারা তার লাশ নগদাশিমলা বাজারে নিয়ে এলে বহু মানুষ তাতে থুঁতু ফেলে ঘৃণা প্রকাশ করেন। ওই এলাকার বহু প্রবীণ মানুষ, যারা এখনো বেঁচে অাছেন, তাদের নিশ্চয়ই রাজাকারের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের এ স্মৃতি মনে অাছে।

এরপর হেমনগরসহ এলাকার বেশ কটি গেরিলা যুদ্ধে ও হুমায়ুন বেঙ্গল সাহসিকতার পরিচয় দেন। এসব নিয়ে গোপালপুরের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, হুমায়ুন বেঙ্গলের উপর যারপরনাই ক্ষিপ্ত ছিলেন।

সে সময় গোপালপুর-ভূঞাপুরের নির্বাচিত অাওয়ামীলীগের এম.এন.এ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মরহুম হাতেম অালী তালুকদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধের সংগঠক হিসাবে গুরুদায়িত্ব পালনে ভারত চলে যান। তার গ্রামের বাড়ি ছিল গোপালপুর উপজেলার হাদিরা ইউনিয়নের মাহমুদপুর গ্রামে।
অার মাহমুদপুরের পাশেই পানকাতা ইসলামীয়া হাইস্কুল ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ুন বেঙ্গলের সশস্ত্র ক্যাম্প। সুতরাং মাহমুদপুর ও পানকাতা গ্রাম দুটি পাকিস্তানী হানাদার বাহনীর লক্ষস্থলে পরিণত হয়।

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। একজন পাকিস্তানী মেজর ও দুজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে, ভারী অস্ত্রশস্ত্র সমবিহারে, দুই শতাধিক পাঞ্জাবী সৈন্য ও কয়েক’শ প্রশিক্ষিত রাজাকার আলবদর নিয়ে, গোপালপুর থেকে যাত্রা শুরু করেন হানাদার বাহিনী। নগদাশিমলা হয়ে তারা প্রথমে মাহমুদপুর গ্রামে পৌঁছেন। সেখানে এম.এন.এ হাতেম অালী তালুকদারের বাড়িতে প্রথম অগ্নিসংযোগ করেন। এরপর গোলাবর্ষন করতে করতে পানকাতার দিকে রওনা হন ঘাতকরা।

মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন বেঙ্গল কোম্পানির অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন সকালে, জরুরী অভিযানের প্রয়োজনে সরিষাবাড়ী ও ভূঞাপুর রণাঙ্গনে চলে যান। পানকাতা ইসলামীয়া হাইস্কুল ক্যাম্পে কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ুন বেঙ্গলসহ বড়জোর ৩০/৩৫জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন। তাদের হাতে ছিল শুধু থ্রি.নট.থ্রি রাইফেল।

পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরাট লাটবহর দেখেও বাঙলার দামাল ছেলেরা সেদিন, পিছিয়ে যায়নি। স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে হুমায়ুন বেঙ্গল হানাদার মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেন। মাহমুদপুর গ্রামের বটতলা ত্রিমোহনা মোড়ে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নেন। দক্ষিন দিক থেকে কুঁঠালবাড়ী মোড়ে পৌঁছামাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা অানোয়ার খসরু এবং নান্নু তালুকদার ফায়ার ওপেন করেন।

শুরু হয় অসম যুদ্ধ। হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্র এবং সংখ্যাধিক্যের বিপরীতে, হালকা রাইফেল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মাত্র ঘন্টা খানেক লড়াই করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে বাধ্য হয়ে, তারা পিঁছু হটেন।

এরপর হানাদার বাহিনী নৃশংসতার উন্মত্ততায় মেতে উঠেন। সামনে যাকে পান তাকেই গুলি করতে থাকেন। বাড়িঘর, দোকানপাট জ্বালিয়ে ক্রমান্বয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। ঘাতকরা পানকাতা, নিয়ামতপুর, চরপাড়া, কয়ড়া হয়ে বিকেলে ধনবাড়ী উপজেলা শহরে পৌঁছেন।

এ অভিযানে যেসব রাজাকার অংশ নিয়েছিলো তাদের মধ্যে, পলশিয়া গ্রামের এক রাজাকার এখনো জীবিত রয়েছেন। প্রকাশ্যে রাজনীতি ও করছেন। দীর্ঘ দিন গোপালপুর থানা জামায়াতের অামীর ছিলেন । একটি ফাজিল মাদ্রাসায় প্রভাষক হিসাবে চাকরির পর বছর তিনেক অাগে অবসরে গেছেন। এখন জামায়তের অামীর না থাকলেও দলের সক্রিয়কর্মী।

গোপালপুর থাকা পুলিশ সম্প্রতি নলিন বাজার থেকে যে ৩৫জন জামায়াত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেন তাদের মধ্যে এ রাজাকারও রয়েছে। বলা অনাবশ্যক, মাহমুদপুর গণহত্যার সাথে যেসব রাজাকার অালবদর জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যে পলশিয়ার অাবুল সর্দার এবং মাহমুদপুর গ্রামের মহিরউদ্দীন কুঁঠাল ৭১ সালের ডিসেম্বরে কালিহাতীর যুদ্ধে নিহত হন। অার এ গণহত্যার অন্যতম নেতৃত্বদানকারি পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন শোয়েব গাজীপুরের সফিপুরের যুদ্ধে নিহত হন।

বলা প্রয়োজন, সেদিন যারা হানাদার বাহিনীর গুলিতে অাহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে মাহমুদপুর গ্রামের লুৎফর রহমান মাস্টারসহ, ৩/৪জন এখনো জীবিত রয়েছেন। যারা এখনো শরীরে গুলির ক্ষতচিহ্ণ বয়ে বেড়াচ্ছেন।

যেদিন এই যুদ্ধ ও গণহত্যা সংঘটিত হয় সেদিন বাড়িতেই ছিলাম। তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। অামার বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচশ গজ দূরে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অাহত এবং নিহতরা সকলেই ছিলেন পড়শী, পরিচিত ও স্বজন। কাজেই সেদিনের যুদ্ধ ও গণহত্যার বিভীষিকা জীবনে চিরস্থায়ী দাগ কাটে। এজন্য পাকিস্তানী হানাদার এবং তাদের দোসর রাজাকার অালবদরকে অামি ঘৃণা করি।

২০০৫ সাল থেকে গণহত্যা দিবসটি পালন শুরু হয়। প্রথম থেকেই মূল উদ্যোক্তা ছিলাম। অামাকে সহযোগিতা করতেন গোপালপুর উপজেলা অাওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং নন্দনপুর রাধারাণী গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষক, মাহমুদপুর নিবাসী মরহুম অাব্দুল মান্নান। পরবর্তীতে এগিয়ে অাসেন ধনবাড়ী প্রেসক্লাবের সভাপতি স.ম জাহাঙ্গীর অালম এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও হাদিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অাব্দুল কাদের তালুকদার।

ডেঙ্গু এবং মাইল্ডস্ট্রোকে অামার স্বাস্থ্যহানি ঘটায় এবং অনুষ্ঠান অায়োজনের খাঁটাখাটির সামর্থ না থাকায় এবার দিবসটি পালনে কয়েকজন অাওয়ামীলীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ এগিয়ে অাসেননি। সম্ভবত এখানে কোনো লাভ নেই ভেবেই তারা অামাকে বিমুখ করেছেন। দিবসটি পালনে বরাবরই কোনো চাঁদা নেয়া হয়না। অামরা অায়োজকরা তিনচার জন মিলে, খরচ বহন করে থাকি। তবে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর অনুষ্ঠান হয় প্রতিবছর।

টানা ১৮ বছর ধরে দিবসটি পালন করে অাসছি। ওই দিন শহীদের স্বজন, যুদ্ধাহত এবং যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত থাকেন। মিলাদ, দোয়া-খায়ের, সংবর্ধনা এবং স্মৃতিচারণ চলে দিনব্যাপি। স্কুলকলেজের ছেলেমেয়েরা থাকেন দর্শকশ্রোতা হিসাবে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো নতুন প্রজন্মের সামনে
তুলে ধরা সম্ভব হয়।

জামায়াত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দল। গণহত্যা ওরা কখনোই স্বীকারই করেনা। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শুধুমাত্র একজন মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত দল মুক্তিযুদ্ধের অনেক ধ্রুব বিষয়কে পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করেন। এ দলের নেতাকর্মীরা মাহমুদপুর গণহত্যা দিবস পালনে কখনো কোনো সহযোগিতা করেননি।

অাওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। টানা ১১ বছর তারা ক্ষমতায়। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তারা অনেক যুগান্তকারি পদক্ষেপ নিয়েছেন। দেশ এগিয়েও যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকায় অাওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা দলীয় নীতি অাদর্শ বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র লুটপাটের দিকেই নজর নিবিষ্ট করেছেন। লুম্পেন চরিত্রের পুরোটাই তারা অাত্বস্ত করেছেন।

এজন্য অাজ দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে নেতা বড়, নেতার চেয়ে উদর বড়। চতুর্দিকে শুধু লুট অার লুটের খবর। এ জন্য নীতি অাদর্শের নামে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার দোকান সাঁজিয়ে বসেছেন অনেকেই। এজন্যই গণহত্যা দিবস পালণে এসব দোকানদারের কোনো সাড়া পাইনি। বিষয়টি অতীব দুঃখের। কোথায় চলেছি অামরা!

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.