বিএনপিও গুম-খুনের কথা বলে, বিস্মিত প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপি কীভাবে গুম-খুনের কথা বলে, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা আর সেই শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের ফাঁসির কথা তুলে ধরে এই মন্তব্য করেন তিনি।

শোকের মাস আগস্ট স্মরণে শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনায় বক্তব্য রাখছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি এসব কথা বলেন।

দীর্ঘ বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার ‘প্রমাণও’ তুলে ধরার পাশাপাশি তার শাসনামলে ঘটা নানা ঘটনার কথাও উল্লেখ করেন। 

জিয়াউর রহমান দেশে সর্বপ্রথম গুম-খুনের রাজনীতি শুরু করেছিলেন অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু আমাদের দলের লোকদের হত্যা করা হয়েছিল এমন নয়। সেনাবাহিনীর অফিসার, যারা একটা সময় জাতির পিতার ডাকে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধ করেছিল, তাদেরকেও একে একে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ওই খুনি জিয়াউর রহমান।’

‘৭৫ এর পর ১৯ টা শুধু ক্যু-ই হয়েছে। সেনাবাহিনী-বিমানবাহিনীর শত শত অফিসারকে হত্যা করেছিল। শুধু তাই না, সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সৈনিককে হত্যা করা হয়েছিল। অনেকে হয়ত ছুটিতে থেকে জয়েন করেছে, তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অনেকে হয়তো জানতেও পারেনি তাদের কেন হত্যা করা হচ্ছে, ডিফেন্ড করার সুযোগ দেওয়া হয়নি; গুলি করে হত্যা করেছে-ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে।’

‘শোনা যেত জিয়ার রহমান নাকি কাটা চামচ দিয়ে খেতে খেতেই মৃত্যুদণ্ডের ফাইলে সই করতেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ওই সময়ে যারা কয়েদি ছিল, তারা বলতে পারবে এক-এক রাতে আট জন ১০ জন করে জোড়ায় জোড়ায় ফাঁসি দিয়েছে। তাদের কান্নায় চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে উঠতো। আর এখন সেই বিএনপি গুম, খুনের কথা বলে!’

জিয়ার ক্ষমতা দখলকে উচ্চ আদালতে অবৈধ ঘোষণার বিষয়েও কথা বলেন আওয়ামী লীগ প্রধান। বলেন, ‘তাহলে তো বিএনপির জন্মই অবৈধ হয়ে যায়। যারা খুনিদের পুরস্কৃত করে, তারা খুনিদের দল হবে না কেন? এরা খুনির দল ছাড়া আর কী? তাদের জন্ম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।’

জিয়ার সম্পৃক্ততার ‘প্রমাণ’

বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় উপসেনাপ্রধান ছিলেন জিয়াউর রহমান। এরপর রাষ্ট্রপতি হয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তাকে সেনাপ্রধান বানান। আর এই প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

বলেন, ‘যাকে সব থেকে বিশ্বস্ত মনে করে তাকেই সেনাপ্রধান করা হয়। খন্দকার মোশতাক যখন নিজেকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে, তখন জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে বেছে নিয়েছিল। জিয়াউর রহমান যদি এই ষড়যন্ত্রের সাথে লিপ্ত না থাকতো তাহলে মোশতাক কখনোই তাকে সেনাপ্রধান করত না।’

জিয়াউর রহমানের শাসনামলে খুনিদের বিচার থেকে রক্ষা করতে ইনডামিটি অডিন্যান্স সংবিধানে সংযোজন, খুনিদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করার কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। পাশাপাশি তাদের দুই বোনের পাসপোর্ট নবায়ন না করা, তাদেরকে দেশে আসতে না দেওয়া এবং এই হত্যার তদন্তে বিদেশিদেরকে আসতে বাধা দেওয়ার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

১৯৭৯ সালে শেখ রেহানার সুউডেনে প্রতিবাদ সভায় বক্তৃতা রাখার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সে সময় রেহানার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে দূতাবাস পার্সপোর্টের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়নি। কারণ সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছিল।’

‘আমি দিল্লিতে ছিলাম। সেখানে রাষ্ট্রদূত ছিলেন শামসুর রহমান সাহেব। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসামি ছিলেন। তিনি

কাউকে কিছু না জানিয়ে আমাদের পাসপোর্ট রিনিউ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যের দূতাবাস পাসপোর্ট দেয়নি। কারণ, উদ্দেশ্য একটাই ছিল কোনোভাবে যেন আমরা আর দেশে না আসতে পারি।’

‘৮০ সালে আমরা যখন যুক্তরাজ্যে যাই ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতায় সেখানে আমরা প্রথম প্রতিবাদ সভা করি। এবং সেখানে একটা ইসভেস্টিগেশন কমিশন গঠন করি।’

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করা স্যার টমাস উইলিয়ামস, আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ব্রিটিশ কয়েকজন এমপিদের দিয়ে সে সময় একটি ‘ইনকোয়ারি কমিটি’ গঠন করে আওয়ামী লীগ। ঠিক হয় স্যার টমাস উইলিয়ামস ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের তদন্ত করবেন। কিন্তু তিনি আসতে পারেননি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি যখন ভিসা চাইলেন জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি। তিনি তাকে ভিসা দেননি। প্রশ্ন এখানে, আর আমি বিএনপির নেতাদের এটা জিজ্ঞাসা করি, জিয়া যদি খুনি না হবে আর তার হাতে প্রতিষ্ঠিত বিএনপি এরা যদি খুনিদের দল না হয় তাহলে স্যার টমাস উইলিমায়সকে সেসময় কেন বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হয়নি?’

বঙ্গবন্ধু হত্যায় তারই মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্যের জড়িত থাকার প্রমাণও আছে। এই প্রসঙ্গেও কথা বলেন তার কন্যা। বলেন, ‘এটা ঠিক আমার বাবার ক্যাবিনেট মিনিস্টার থেকে অনেকেই এটার সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের সহযোগী ছিল ওই জিয়াউর রহমান।’

‘তারা কীভাবে এতটা মোনাফেকি করতে পারল!’

বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সব সময় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে পড়ে থাকার কথা তুলে ধরে বিস্ময়ও প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। প্রশ্ন তোলেন, তারা কীভাবে এতটা বেইমানি করতে পারল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাসভবন আক্রমণ করে সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনককে। দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান বিদেশে পালিয়ে থাকায়।

এই হত্যাযজ্ঞে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আগে থেকেই যেতেন। সে কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অবাক লাগে যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল তারা প্রতিনিয়ত আমাদের বাড়িতে আসতো। আমাদের বাড়িতে ভাত খেত।’

‘তাদের বউ, ছেলে-মেয়ে, শাশুড়ি সবাইকে নিয়েই, ডালিম-ডালিমের বউ, ডালিমের শালি, ডালিমের শাশুড়ি, একেবারে সকাল থেকে সারাদিন আমাদের বাড়িতে…এজন্য সব সময় আসা যাওয়া করত।’

‘কে না আসত? কর্নেল ফারুক, সে আসা যাওয়া করত। কিন্তু এদের ভেতরে যে এ চক্রান্ত ছিল, এই ষড়যন্ত্র ছিল এটা কখনও তিনি (বঙ্গবন্ধু) স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। বা আমরাও চিন্তা করতে পারিনি। যে এতবড় বেঈমানি, মোনাফেকি কোন মানুষ করতে পারে।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত চলছে-এই বিষয়টি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পেরেছিল। জাতির জনককে সতর্ক করেছিলেন কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোও। কিন্তু বাঙালিরা তাকে হত্যা করতে পারে না- এই বিশ্বাসে অটল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর সেটাই কাল হয়েছে।

জাতির জনকের কন্যা বলেন, ‘আপনারা যদি একটু চিন্তা করে দেখেন, যেভাবে নারী হত্যা, শিশু হত্যা- ঠিক ৭১ এর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল ঠিক মনে হল সেই ঘটনাই।’

‘কারবালার ময়দানের যে ঘটনা মনে হল যে কারবালার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল ৩২ নম্বরে।’

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.