তিস্তার পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপরে ১৫ হাজার পরিবার পানি বন্দি

0

আবু মোতালেব হোসেন,নীলফামারী প্রতিনিধিঃ

টানা ভারী বর্ষন আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার (১৩ জুলাই) সকাল ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৬০) ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানির প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোডের পানি পরিমাপক উপ-সহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশিদ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, উজানের ঢল সামাল দিতে খুলে রাখা হয়েছে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি শ্লুইস (৪৪টি) গেট (জলকপাট)।

নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা প্রায় ১৫টি চর ও চরগ্রাম হাটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়েছে। এতে প্রায় ১৫ হাজার পরিবারের ৭৫ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া তিস্তা বিপদসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানের বাঁধ গুলো হুমকির মুখে পড়েছে।

জেলা প্রশাসনের পক্ষে তিস্তার বন্যায় ডিমলা উপজেলায় ৫০মেট্রিক টন চাল, নগদ ৫০ হাজার টাকা ও ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়নুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের বিস্তীর্র্ণ এলাকার ১৫টি চর ও গ্রামের পরিবারগুলো বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে ।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সর্তকীকরন কেন্দ্র জানিয়েছে বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) সকাল ৬টায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও তা সন্ধ্যা ৬টায় ২৫ ও রাত ৯টায় আরও ৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

শুক্রবার (১২ জুলাই) সকাল ৬টায় বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৬০) ২৪ ও সন্ধায় ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে তিস্তা পাড়ের মানুষজন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই হিসাব মানতে নারাজ। এলাকাবাসীর পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে ধারনা করছে তিস্তা নদীর পানি কম করে হলেও বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাদের দাবি, পানি উন্নয়ন বোর্ড অজ্ঞাত কারনে নদীর পানির সঠিক হিসাব প্রকাশ করছে না।

উপজেলার পূবর্ ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রভাষক আব্দুল লতিফ খান জানান, গত দুই দিনের বন্যার চেয়ে শুক্রবার উজানের ঢলে পানির গতিবেগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এলাকার উঁচু, নিচু স্থানে নদীর পানি প্রবেশ করেছে। ইতিমধ্যে এলাকার ১ হাজার ১৪০ পরিবারের বসত বাড়ীতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এলাকার ঝাড়শিঙ্গেরশ্বর মৌজাটি তলিয়ে গেছে। হুমকীর মুখে পড়েছে সেখানকার মাটির রাস্তাগুলো। রাস্তার উপর দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ায় এলাকাবাসী বালির বস্তা দিয়ে পানি ঠেকানোর চেস্টা করছে।

পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড়সিংশ্বর চরের বাসিন্দা বানভাসী হামিদুল ইসলাম বলেন, গত তিনদিন ধরে পরিবার পরিজন নিয়ে পানিবন্ধি হয়ে আছি। চাল চুলো জ্বালানোর কোন উপায় না পেয়ে শুকনো খাবার খেয়ে বেঁছে আছি। গবাদী পশুসহ অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বানভাসীদের জন্য বরাদ্দ হলেও এখনও তা বন্টন করা হয়নি।

ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, ছাতুনামার চর,ফরেষ্টের চর, সোনাখুলীর চর ও ভেন্ডাবাড়ি চরে দেড় হাজার পরিবারের বসতবাড়ীতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। তিনি জানান, দক্ষিন সোনাখুলী এলাকায় তিস্তা নদীর ডান তীরের প্রধান বাঁধের অদুরে ইউনিয়ন পরিষদের তৈরী করা মাটির বাঁধ হুমকীর মুখে পড়েছে।

বাঁধের উপর দিয়ে তিস্তা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় দক্ষিন সোনাখুলী কুঠিপাড়া গ্রামের বসত ঘর ও আবাদী জমিগুলো তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই বাঁধটি বিধ্বস্থ্য হলে এলাকাটি বিলিন হবার ধারনা করা হচ্ছে। ইতো মধ্যে আমনের বীজতলা পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

উপজেলার খালিশা চাপানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান সরকার বলেন, পূর্ব বাইশ পুকুর ও ছোটখাতা মৌজার ৫ শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ীতে বন্যার পানি বয়ে যাচ্ছে। টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়নুল হক বলেন তার এলাকার দক্ষিন খড়িবাড়ি ও পূর্ব খড়িবাড়ি, একতার চর, টাবুর চর মৌজায় তিস্তার বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ইতিমধ্যে দুই সহ¯্রাধিক পরিবারের বসতবাড়ীতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শৌলমারী বান পাড়ায় ডানতীর গ্রাম রক্ষা বাধে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দা আশরাফ আলী জানায়, পরিবার পরিজন নিয়ে খুবেই আতঙ্কে আছি, এই বাধ ভেঙ্গে শুধু বান পাড়ায় নয়, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের ২০ হাজারেরও বেশি পরিবারের ঘরবাড়ি তিস্তা নদীতে পানিতে তলিয়ে যাবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, বানপাড়া বাঁধ ৬০ মিটার পর্যন্ত ভাঙ্গন পাওয়া গেছে। আমরা ১২০ মিটার পর্যন্ত এই ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করছি। তবে এ বাধটি প্রকল্পের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে রক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যা আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এর কাজ শুরু করা হবে।

অপরদিকে, ডিমলা উপজেলার চরখড়িবাড়ি এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি তিস্তার পানি তোড়ে ভেঙ্গে গিয়ে এলাকার ২ হাজার পরিবার নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, উজানের ঢল ও বৃস্টিপাতের কারনে আমরা সর্তকাবস্থায় রয়েছি। শুক্রবার তিস্তা নদীর পানি সকাল ৬টায় বিপদসীমা অতিক্রম করে ২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে বিকাল ৩ টায় বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ও সন্ধ্যায় ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

শনিবার (১৩ জুলাই) সকাল ৬টায় বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যারাজের সবকটি শ্লুইস (৪৪টি) গেট খুলে রাখা হয়েছে।

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুন নাহার মুন বলেন, কিছু মানুষজন নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে আর কিছু পানিবন্ধি অবস্থায় বাড়ীতে রয়েছে। তবে বন্যা কবলিত এলাকায় এখনও রেড এর্লাড জারি করা হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গতকালের বরাদ্দকৃত মালামাল আজকে বিতরন করা হবে। ভাসভাসীদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা রয়েছে।

নীলফামারী জেলা ত্রান ও দুযোগ কর্মকর্তা এসএ হায়াত জানায়, শুক্রবার (১২ জুলাই) বিকালে ডিমলা উপজেলায় ৫০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৫০ হাজার টাকা ও ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আজকে জেলা পর্যায়ে বৈঠকের পর কতটুটু বরাদ্দ বানভাসীদের দেওয়া হবে সেটা পরে জানানো হবে।

Leave A Reply