এখন বাংলাদেশে তাল গাছের অভাবে হুমকির মুখে বাবুই পাখি

0
স্বাধীন বাংলা নিউজ টিভি রিপোর্টার মোঃতপছিল হাছানঃ বিভিন্ন সময় দেখা গ্রাম গুলো উনুবাভ সরেজমিনে গিয়ে জরিপ অনুযায়ী পরিভর্তন, বাবুই পাখিরে ডাকিয়া বলিছে চড়াই- কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই, আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ-বৃষ্টি ঝড়ে।’ বাবুই হাসিয়া কহে- সন্দেহ কী তাই? কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়, পাকা হোক তবু ভাই পরেরও বাসা, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।’
কবি রজনী কান্ত সেনের এই কবিতাটির মাধ্যমে ছোটবেলায় আমাদের শিক্ষকরা স্কুলের পাশের তাল গাছে বাবুই পাখির বাসা দেখিয়ে সততা আর নৈতিক শিক্ষা দিতেন। আত্মলড়াইয়ের পাঠ দিতেন।
নিজের কাজকে ভালোবাসা ও সম্মানের শিক্ষার উদাহরণ হিসেবে শিল্পের কারিগর বাবুই পাখি আজও রয়েছে আমাদের অন্তরজুড়ে। একটা সময় ছিল যখন আমাদের আশেপাশে প্রচুর তাল গাছ ছিল। আর সেই গাছে প্রকৃতির ধ্রুপদী নিপুণ শিল্পী বাবুই যার একেকটি বাসা একেকটি বৃহৎ শিল্প কর্ম গড়ত। পরম ধৈর্য নিয়ে আপন মনে বুনে যেতো নিজ বাসা।
বাবুই পাখি শুধু পরিশ্রমী আর সততার প্রতীক হিসেবেই আমরা চিনি। কিন্তু এই বাবুই পাখিটির শিল্পগুণের পেছনে রয়েছে অন্য কাহিনী। আর সেটি তার প্রেমিকাকে খুশি করার অদম্য বাসনা।
বাবুই পাখির যখন প্রজনন মৌসুম আসে তখন পুরুষ বাবুইটি একের পর এক বাসা গড়তে থাকে তার প্রেমিকা স্ত্রী পাখিটিকে খুশি করতে। একেকটি পুরুষ বাবুই ১ থেকে ২০টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করে। বাসা তৈরির কাজ শেষ হলে সুরে সুরে তার প্রেমিকাকে আহবান করে। তার ডাকে কাছে আসে স্ত্রী বাবুই পাখি। এসেই পরখ করে দেখে কেমন হল তার বাসা।
যদি সে বাসা পছন্দ হয় এবং নিরাপদ মনে করে তবেই সে মিলিত হয় পুরুষ বাবুইর সাথে। তাদের বাসায় ডিম আসে, বাচ্চা ফুটে। একই সাথে একটি পুরুষ বাবুই একাধিক সংসার গড়ে তাই এতো বাসা তৈরি করে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য এম. এ তাহের জানান, বাবুই পাখি সাধারণত তিন ধরনের বাসা তৈরি করে। প্রথমত, নিচের দিকে অনেক লম্বা সরু একটা রাস্তা থাকে যে রাস্তা দিয়ে বাসার ভেতরে সে ঢুকে। এমন বাসা সংসারের জন্য অনাগত ছানার জন্য নিরাপদ।
দ্বিতীয়, বেশির ভাগ অংশ খোলা থাকে। এমন বাসা বানানোর পেছনের কারণ হচ্ছে বাবুই পাখিটি এই বাসায় বিশ্রাম করে বা এখানে বসে আশেপাশে সতর্ক পাহারা বসায়।
আরেকটি বিশেষ ধরনের বাসা বানায় যার ভেতরে দুইটি অংশ থাকে। সে বাসায় সংসার ছানাসহ বিশ্রামের আলাদা জায়গা থাকে।
কিন্তু চিরচেনা সেই দৃশ্য এখন আর তেমন দেখা মিলে না, কারণ উঁচু তাল, নারিকেল, সুপারি গাছ কমে যাওয়ায় বাসা বুনার উপযুক্ত স্থান হারাচ্ছে ক্রমশ। অতিলোভে দামী গাছ লাগানোর জন্য মানুষ সাবাড় করেছে বাবু্ই পাখির নিরাপদ আবাসস্থল।
বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখির প্রথম পছন্দ তাল গাছ। এরপর নারিকেল বা সুপারি গাছ। এই সব গাছের পাতার সাথে অন্য লতাপাতা মিশিয়ে সে বাসা গড়ে। উপরে বাসা বানানোর কারণে সে নিরাপদে থাকতে পারে। তাল গাছ বা নারিকেল গাছের এত উপরে থাকে সেখানে সাধারণত অন্য কোন কিছুর নাগালের বাইরে থাকে।
সেই বাবুই পাখি ২০-২৫ বছরের ব্যবধানে চরম গৃহসংকটে পড়েছে। এতটাই সংকটে যে বাধ্য হয়ে কলা গাছ বা বিভিন্ন ঝোপে বাসা বানাচ্ছে। বাবুই পাখি প্রজননের এই সময়টায় পরেছে মহাবিপদে। কলা গাছের মত নিচু গাছে ঝুঁকি আছে জেনেও বাসা তৈরি করছে। এই বাসায় বাচ্চারা ঢিল মেরে তাদের ডিম নষ্ট করে দিচ্ছে সহজেই তবুও এই নিচু জায়গা ছাড়া আর তাদের উপায় নেই।
মানুষের হিংস্র থাবার কাছে হার মেনেছে বাবুই পাখির জীবনের মায়া। এমন কিছু বাসার ছবি কেরানীগঞ্জের কিছু এলাকায় দেখতে পান বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য এম. এ তাহের।
তিনি আরও জানান, আমাদের অতি লোভে আমরা তাল গাছ কেটে অন্য গাছ লাগাচ্ছি। তার উপর কিছু কুসংস্কার আছে। গ্রামের মানুষ মনে করে তাল গাছে ভূত বাসা বাধে। আর সে ধারণা থেকেই তাল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বাবুইপাখি আমাদের দেখিয়ে দিল আমরা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট। জ্ঞানের অভাবে টাকার লোভে প্রকৃতি ধ্বংস করে চলেছি উন্নয়নের প্রতিযোগী হয়ে। তাদের এই অবস্থা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি, কি করছি আমরা তাদের সাথে!
নির্লজ্জের মত মাথা নিচু করে রইলাম। এতটা পাষাণ আমরা কি করে হলাম? একটি গাছ কেটে কয়টি গাছ লাগিয়েছি আমরা তা কী ভেবে দেখেছি কখনো?
আমি প্রথম দেখলাম কলা গাছের ডালে এবং কাশবনে বাসা বানাতে আর কেউ দেখেছে কি-না আমার জানা নাই। ধীরে ধীরে কতটা মহাবিপন্নের কাতারে চলে যাচ্ছে এই বাবুইপাখি। প্রকৃতি না বাঁচলে মানুষ কীভাবে বাঁচবে? ভাবছে কি মানুষ?
এ বিষয়ে পাখিবিদ এস আই সোহেল বলেন, এই পাখির বাংলা নাম- দেশি বাবুই, ইংরেজি নাম- Baya Weaver, বৈজ্ঞানিক নাম- Ploceus philippinus।
সাধারণত মে থেকে আগস্ট বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। একটি পুরুষ পাখির একাধিক বাসা ও পরিবার থাকতে পারে। এরা সাধারণত ২ থেকে ৪টি ডিম দেয়। ডিম ফোটে ছানা বের হতে ১৪ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। মেয়ে পাখি একা ডিমে তা দেয়।
একটি ছানা ১৪ থেকে ১৬ দিনে নিজের মত চলার সক্ষমতা অর্জন করে বাসা ছেড়ে দেয়। বাবুই পাখিদের খাদ্য তালিকায় আছে ঘাস-বীজ, খাদ্যশস্য ও পোকামাকড়।
তিনি আরও জানান, বাবুই পাখি তাল, নারকেল, সুপারি, খেজুর ও বাবলা গাছে বাসা করে থাকে। তবে বাসার জন্য সব চেয়ে বেশী পছন্দ করে তাল গাছ। কিন্তু প্রকৃতি উজাড় করে তাল গাছ কেটে তাদের আবাসন আমরা ইতিমধ্যে নষ্ট করে ফেলেছি। কতটা নির্মম পরিস্থিতিতে তারা কলা গাছ বা কাশবনে বাসা বানাতে পারে? এর থেকে প্রমাণ হয় যে আমরা কিভাবে ধ্বংস করছি প্রকৃতিকে।
Leave A Reply