লামায় চিকিৎসকের অর্থ আত্মসাত: দুদকের দৃষ্টি আকর্ষণ

সাইফুল ইসলাম: বান্দরবান জেলা প্রতিনিধি: 
স্বাধীনতার পর দেশের প্রকৃত গণমুখী কার্যক্রমের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা সরকারের সবচেয়ে একটি সফল উদ্যোগ। এ ক্লিনিকের মাধ্যমে মা ও শিশুর পাশাপাশি প্রান্তিক জনপদের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে কিমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারা (সিএইচসিপি)। কিন্তু এসব সিএইচসিপি’র প্রতি অশালীন মারমুখী আচরণ, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অর্থ আত্মসাৎ ও অযথা হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন মোর্শেদ বিরুদ্ধে। এতে উপজেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় স্বাস্থ্য সেবার মান ভেস্তে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। ফলে অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের (সিসিএইচএসটি) চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন উপজেলার ২৩ সিএইচসিপি। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মাইনুদ্দীন মোর্শেদ এর এমন কর্মকান্ডে সিএইচসিপিদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এটিকে কেন্দ্র করে যে কোন মুহুর্তে ঘটতে পারে অপ্রীতিকর ঘটনা,-এমন আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল।
জানা যায়, স্বাস্থ্য সেবাকে গ্রামীণ পর্যায়ের জনগণের দৌরগোড়োয় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ১৩ হাজার ৯৯৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে স্থাপিত হয় ২৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রতিদিন গড়ে এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সহ¯্রাধিক দু:স্থ মানুষ স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করে আসছেন। অভিযোগ উঠেছে, এসব ক্লিনিকে বিভিন্ন সময় ক্যাম্পেইন, জাতীয় দিবস সমূহ সিএইচসিপিদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু সরকারীভাবে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও কোন প্রকার খরচের অর্থ পরিশোধ করেন না স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন মোর্শেদ। কথায় কথায় সিএইচসিপিদের বেতন বন্ধ রাখা, বেতন কর্তন করা, উৎসব ভাতা পরিশোধ না করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পরিবহন ভাতা আত্মসাৎ, কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে সেবা গ্রহিতা এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সামনে সিএইচসিপিদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা ডা. মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন মোর্শেদের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপজেলার ২৩জন সিএইচসিপি’র স্বাক্ষরিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০২১-২২ অর্থ বছরে উপজেলার ২৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের নামে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা হারে ঔষধ পরিবহন, ষ্টেশনারি এবং কমিউনিটি ক্লিনিক পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য বরাদ্দ আসলেও, সেখান থেকে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতি ৮ হাজার টাকা প্রদান করে, বাদবাকী ৫ হাজার ৫০০ হারে ১ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন ডা. মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন মোর্শেদ। এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করায় সম্প্রতি কয়েকজন সিএইচসিপিকে চাকুরীচ্যুতের হুমকি দেন এ কর্মকর্তা। এমনকি ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা বাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি উম্মে হায়াত আরজু’র ১ দিনের বেতন কর্তন করেন তিনি। ষ্টেশনারি বিলের কথা বলায়, ডলুছড়ি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করতে গিয়ে তিনি মা-মনি প্রকল্পের ম্যানেজার মংচিংপ্রু, সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য সহকারী, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক, স্বাস্থ্য পরিদর্শকসহ ১৫-২০জন লোকের সামনে সিএইচসিপি যতিন্দ্র ত্রিপুরাকে মা-বাবার নাম ধরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে যোগদানের পর থেকেই ডা. মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন মোর্শেদ এসব অনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে আসছেন বলে জানান, লামা উপজেলার ডিগ্রিখোলা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি ও কমিউনিটি হেলথ্ কেয়ার প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি মাসুদ খান।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য কর্মকর্তার এসব কর্মকান্ডের কারণে জনসাধারণের মাঝে সেবা প্রদানে ব্যঘাত ঘটছে। সুষ্ঠু তদন্ত করলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনিত প্রতিটি অভিযোগের সত্যতা মিলবে বলেও জানান এ সিএইচসিপি।
অপরদিকে উপজেলার ২৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত ১৩৫জন মাল্টিপারপাস ভলান্টিয়ারের স্থলে ১৪৫জন এমএইচভি’র সম্মানি ভাতা সিবিএইচসি কার্যালয় হতে প্রেরণ করলে, ডা. মোহাম্মদ মাইনুদ্দীন মোর্শেদ ১৩৫জনের স্থলে ১৪৩জনের সম্মানি ভাতা উত্তোলন করে ডিডিও হিসাব নম্বরে জমা করেন। পরবর্তীতে অতিরিক্ত ৮জন মাল্টিপারপাস ভলান্টিয়ারের প্রতিজন ৪৩ হাজার ২০০ টাকা হারে ৩ লক্ষ ৪৫ হাজার ২০০ টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। এছাড়াও তিনি ৭-৮জন এমএইচভি-কে ৪৩ হাজার ২০০ টাকার স্থলে ১৬ হাজার, ১৮ হাজার, ২৪ হাজার ও ৩২ হাজার হারে টাকা পরিশোধ করে বাদবাকী টাকা ডিডিও’র হিসাব নম্বর থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। এছাড়াও বেশ কিছু বহিরাগত লোককে তিনি লামা উপজেলার বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকে এমএইচভি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে টাকা আত্মসাতের পায়তারা করিতেছেন। কমিউনিটি ক্লিনিকের ক্যাপচার এরিয়ার বাহির থেকে কোন লোককে এমএইচভি হিসেবে নিয়োগ প্রদান, সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অনৈতিক। তারপরেও গায়ের জোরে তিনি এমন কর্মকান্ড করে যাচ্ছেন।
এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তার বাড়ির কাজের বুয়া ও নিকটাত্মীয়দেরকে বিধি বর্হির্ভুতভাবে বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকে এমএইচভি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেছেন। নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন- শাহেনা বেগম, এমএইচভি, জাহেদ লতিফপাড়া সিসি, সাহারবিল, চকরিয়া উপজেলা, কক্সবাজার। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার বাড়ির কাজের বুয়া। ইয়ারখানুল হক, এমএইচভি, জাহেদ লতিফপাড়া সিসি, ফাসিয়াখালী ইউনিয়ন, চকরিয়া উপজেলা, কক্সবাজার। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার ভাগিনা। ওবাইদুল হাসান, এমএইচভি, জাহেদ লতিফপাড়া সিসি, মানিকপুর ইউনিয়ন, চকরিয়া উপজেলা, কক্সবাজার। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ভাগিনা। লাভলু দাশ, এমএইচভি, টিয়ারঝিরি সিসি, বাজার পাড়া, লামা পৌরসভা। তিনি বর্তমানে ইউনিয়ন হিসাব সহকারী হিসেবে কর্মরত আছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের, এমএইচভি, টিয়ারঝিরি সিসি, চম্পাতলী, ১নং ওয়ার্ড, লামা পৌরসভা। প্রহেলিকা ত্রিপুরা, এমএইচভি, জাহেদ লতিফ পাড়া সিসি। তিনি লামা উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা নন।
গত অর্থবছরে সিএইচসিপিদের বেতন ও উৎসব ভাতা যথাসময়ে বরাদ্দ আসলেও, তা পরিশোধ করেননি ডা. মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন মোর্শেদ। এছাড়াও কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) হতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, পরিবহন এবং দিবস উদযাপনের জন্য ১১ হাজার টাকা বরাদ্দ আসলেও তিনি তা পরিশোধ না করে, আত্মসাতের উদ্দেশ্যে প্রতি কমিউনিটি ক্লিনিকে ১জন করে পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ প্রদান করবেন বলে প্রতারনা মূলক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তিনি। এতে অনেকেই কমিউনিটি ক্লিনিকে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য আবেদন জমা দেন এবং সিএইচসিপিদের কাছে লবিং করেন। দীর্ঘ ৪-৫ মাস ধরে সিএইচসিপিদের সাথে কোন মাসিক মিটিং এর আয়োজনও করেননি এ কর্মকর্তা। নিয়োগকৃত এমএইচভিগণ দীর্ঘ ১১মাস ধরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিত কাজ করেও তিনি সম্মানিভাতা পরিশোধ করেননি। প্রতিটি ক্ষেত্রে টাকা আত্মসাতের লক্ষে কালক্ষেপন করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ডা. মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন মোর্শেদের। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার এসব কর্মকান্ডের কারণে গ্রামীণ পর্যায়ে জনগণের মাঝে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে ব্যঘাত ঘটছে বলে জানান মানবাধিকার কর্মী এম. রুহুল আমিন।
তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন মোর্শেদ বলেন, আমি প্রায় সময় সরেজমিন কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শনে যাই। এতে প্রোভাইডারদের অনুপস্থিতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। মূলত এ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে সিএইচসিপিরা আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলেছেন।
এদিকে বান্দরবান সিভিল সার্জন ডা.নিহার রঞ্জন নন্দী জানান, ২৩ সিএইচসিপি কর্তৃক লামা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাঈনুদ্দীন মোর্শেদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের কপি পেয়েছি। তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.