গাজীপুরে নিরাময় কেন্দ্রে মাদককারবার-অনৈতিক কাজ চালাতেন তারা

গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রেটি ছিল মাদক কারবারের একটি আখড়া। নিরাময় কেন্দ্রের আড়ালে এখানে মাদক ব্যবসা ছাড়াও নানা অনিয়ম ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলত। রোগীদের থেকে পর্যাপ্ত টাকা নিলেও সে অনুযায়ী সেবা-পরিচর্যা মিলত না। ছিল না কোনো চিকিৎসক। এছাড়াও নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত রোগী রাখা হয়েছিল সেখানে। তাদের ওপর চলত নির্যাতন। এছাড়াও তাৎক্ষণিক ডোপ টেস্টে প্রতিষ্ঠানটির মালিক-কর্মচারীরা মাদকাসক্ত বলে প্রমাণ হন।

নানা অভিযোগের ভিত্তিতে মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এই ঘটনায় ঢাকাই চলচ্চিত্রের একজন অভিনেতাসহ ২৮ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে এলিট ফোর্স র্যাব সেখানে অভিযান চালায়। এসময় ৪২০ পিস ইয়াবা, নির্যাতনে ব্যবহৃত লাঠি, স্টিলের পাইপ, হাতকড়া, রশি, গামছা, খেলনা পিস্তল ও কথিত সাংবাদিকের পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়।

বুধবার দুপুরে র‌্যাব-২ ব্যাটেলিয়ন সদরদপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান এলিট ফোর্সটির মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

গ্রেপ্তাররা হলেন- প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফিরোজা নাজনিন বাঁধন, মনোয়ার হোসেন সিপন, রায়হান খান, দিপংকর শাহ দিপু ও জাকির হোসেন আনন্দ।

কমান্ডার মঈন জানান, এবছরের ১লা জানুয়ারি চলচ্চিত্র সমিতি র‍্যাবকে জানায় একজন চিত্রনায়ক দীর্ঘদিন তাদের কার্যক্রমে অনুপস্থিত। পরবর্তীতে তারা জানতে পারেন তিনি (চিত্রনায়ক) গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। এমন তথ্যে র‍্যাব সদর দপ্তর ও র‍্যাব-২ এর দল ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিযান চালায়। সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় কোনো আয়োজন ছিল না। বিশেষ করে তিনটি রুমে ২৮ জনকে গাঁদাগাদি করে রাখা হতো। বিভিন্ন সময় সেবা নিতে আসা প্রত্যাশীদের মারধর করা ছাড়াও নিন্মমানের খাবার পরিবেশন করত। কিন্তু পরিবারগুলো থেকে প্রথমে ভর্তি ফি তিন লাখ এবং প্রতিমাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেওয়া হতো। কিন্তু এতো টাকা নেওয়া হলেও সেবার মান ছিল খুবই নিম্নমানের।

কে এই ফিরোজা?

গ্রেপ্তার ফিরোজা নাজনিন বাঁধনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সে ২০০৯ সালে ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রটি অনুমোদনহীনভাবে গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে ২০১৩-২০১৪ সালে সাময়িক অনুমোদন পায়। প্রতিষ্ঠানটির মালিক তিনি নিজেই। যার কর্মী সংখ্যা ছিল চারজন। আর বর্তমানে রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ছিল ২৮ জন। আর দুইতলা ভবনটি প্রতিমাসে ভাড়া দিতেন ৪০ হাজার টাকা।

যেসব তথ্য পেয়েছে র‍্যাব:

র‍্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের অভিযুক্ত ফিরোজা নাজনিন বাঁধন জানিয়েছেন, তিনি প্রতি রোগীর কাছ থেকে প্রতিমাসে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিতেন। নিরাময় কেন্দ্রে দুই জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কোনো চিকিৎসককে সেখানে পাওয়া যায়নি। সেখানে ২০ জন রোগীর চিকিৎসার অনুমোদন থাকলেও ২৮ জন রোগী পাওয়া যায়।

যত অভিযোগ:

মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বেশকিছু গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, যেভাবে নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করার কথা, চিকিৎসা দেওয়ার কথা, রোগীদের সেবা করার কথা সেখানে কিছুই তারা করত না। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফিরোজা নাজনিনের বিরুদ্ধে ভিকটিম ও তার আত্মীয়রা জানিয়েছে, চিকিৎসার নামে শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করা হতো। চিকিৎসার নামে রশির সাহায্যে ঝুলিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। প্রতি বেলায় খাবারের মানও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। তাছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যেসব নির্দেশনা ছিল তার কিছুই এখানে ছিল না।

তাছাড়া সবসময় ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না। নিরাময় কেন্দ্রের মালিক এবং কর্মচারীদের তৎক্ষণাৎ র‍্যাপিড ডোপ টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে তারা মাদকাসক্ত ছিল।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.