গোপালগঞ্জে কোটি টাকার মিশনে পুস্তক প্রকাশক কোম্পানী প্রতিনিধিরা-দেখার যেন নেই কেউ

0

গোপালগঞ্জ – প্রতিনিধি

গোপালগঞ্জ জেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নতুন বছরের নতুন শ্রেণিতে ওঠা আর নতুন বইয়ের উৎসব সব কিছু ম্লান কওে দিচ্ছে কতিপয় গাইড বই কোম্পানী আর জেলার কিছু শিক্ষক নামের ব্যবসায়িরা।

নতুন বছরের শুরুতে নতুন বই সরবরাহ করার সঙ্গে সঙ্গে লিখে দেওয়া হচ্ছে এই বই পড়ার জন্য সহায়ক হিসাবে এই গাইড অবশ্যই কিনতে হবে। গাইড বই না কিনলে তারা পড়া বুঝতে পারবে না এমনকি অকৃতকার্য হওয়ার ভয় পর্যন্ত দেখানো হচ্ছে।

জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ২৬৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে  ১লাখ ৪১ হাজার ৪ শত ৯৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে গোপালগঞ্জ সদরে ৪টি নি¤œমাধ্যমিক, ৪৩টি মাধ্যমিক, ৬টি মাদ্রাসা, ১টি স্কুল এন্ড কলেজ ও ৮টি কলেজ এবং রয়েছে ৩৫ হাজার ৫ শত ৮২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। জেলার কাশিয়ানীতে ৩টি নি¤œ মাধ্যমিক, ৩৬টি মাধ্যমিক, ১১টি মাদ্রাসা, ১টি স্কুল এন্ড কলেজ ও ৫টি কলেজ প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ছেলে মেয়ে মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ২৯ হাজার ৩ শত ২৯ জন।

এ ছাড়াও কোটালীপাড়ায় ২টি নি¤œ মাধ্যমিক, ৪১টি মাধ্যমিক, ৫টি মাদ্রাসা, ১টি স্কুল এন্ড কলেজ ও ৫টি কলেজ প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ছেলে মেয়ে মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ২৯ হাজার ৬ শত ৩৭ জন। মুকসুদপুরে ৫টি নি¤œ মাধ্যমিক, ৩৮টি মাধ্যমিক, ২১টি মাদ্রাসা, ২টি স্কুল এন্ড কলেজ ও ৩টি কলেজ প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ছেলে মেয়ে মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৫ হাজার ৭ শত ২৬ জন। টুঙ্গিপাড়ায় ১৮টি মাধ্যমিক, ২টি মাদ্রাসা ও ২টি কলেজ প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ছেলে মেয়ে মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ১১ হাজার ২শত ২৫ জন।

কোটি টাকার মিশন নিয়ে বিভিন œবই কোম্পানির প্রতিনিধিরা ২০১৯ শিক্ষা বর্ষের ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদেও পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি নোট-গাইড ও ব্যাকরনসহ অন্যান্য বই শিক্ষার্থীদের কেনার জন্য বলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা  মোটা অংকের অর্থেও বিনিময়ে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এ সব নোটবই, গাইড ও কোম্পানির তৈরী করা সিলেবাস কিনতে বলেন।

যে সব পুস্তক প্রকাশনা কোম্পানী গুলো চষে বেড়াচ্ছে মিশন সফল করতে তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য প্রগতি, অনুপম, লেকচার, আদিল, পাঞ্জেরী, এ্যাডভান্স, নবদূত, ইন্টারনেট, পপিসহ আরো কয়েকটি পুস্তক প্রকাশনা কোম্পানী তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় এজেন্ট ডিলার সেট আপসহ মাঠ পর্যায়ে চষে বেড়াচ্ছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের সাথে বিভিন্ন ভাবে যোগাযোগ করে চুক্তি করছেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যার বিপরীতে চুক্তির ফি নির্ধারণ করছেন, আর বলির পাঠা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

সদর উপজেলার চর বয়রা ঘোনাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী তার অভিভাবককে সাথে নিয়ে বই কিনতে এসেছে, নব বিচিত্রা বইয়ের দোকানে সে প্রগতি প্রকাশনীর একটা গাইড বই চায়, দোকানী তাকে বুকলিষ্ট নিয়ে আসতে বলে, বুকলিস্টে যে বইয়ের উল্লেখ আছে, স্যারেরা কিনতে বলেছেন, অন্য বই নিলে হবে না। স্কুল থেকে দেয়া তালিকার বাইরে অন্য কোনো নোটবই ও গাইড কেনা যাবে না। ছেলেটি ও তার অভিভাবক তাদের নাম প্রকাশ না করার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেছেন।

গোপালগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়দেব চন্দ্র সরকার বলেন, কয়েকটি কোম্পানীর প্রতিনিধিরা আমাকে বিভিন্ন ধরনের উপঢৌকন দেয়ার অফার প্রদান পূর্বক আমার সাথে বারবার যোগাযোগ করেছে তাদের কোম্পানীর বই আমার স্কুলে চালানোর জন্য, কিন্তু আমি তাদের প্রস্তাবে রাজী হইনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বই কোম্পানীর প্রতিনিধি বলেন, আমরা কোম্পানীর গাইড চালানোর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষদেও বিভিন্ন ধরনের উপহার দিয়ে থাকি যেমন আলমারি, টেলিভিশন, কেবিনেট। তারা অনেক সময় এগুলো না নিয়ে নগদ অর্থ ও নিয়ে থাকেন। এসব নোটবই, গাইড বই কিনতে হচ্ছে সেট ভিত্তিক, যদি ইংরেজীর একটা গাইড দরকার হয়, শুধু মাত্র ইংরেজী গাইড বইটা দিবেনা, কিনতে হবে সেট ভিত্তিক।

এ ব্যাপারে বইয়ের দোকানীরা বলেন, কোম্পানী এই নিয়ম করেছে, আমরা কি করবো? দরকার একটি বই অথচ কিনতে হবে সেটসহ।

অবৈধ নোট ও গাইড বইয়ের সমারোহে পড়াশুনা হয়ে যাচ্ছে তৈরিকৃত সব কিছু তৈরী অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে, এমনিতেই আমাদের দেশের শিক্ষকরা মনে করে থাকেন, তাদেও পড়াশুনা এবং পাঠ পরিকল্পনা করার দরকার নেই, শুধু তাদেও শিক্ষার্থীরাই পড়বে, বাজারে বিভিন্ন কোম্পানীর নোট ও গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি! এসব দিয়ে চালানো হচ্ছে শিক্ষা দান নামের মহান কর্মযজ্ঞটি, অথচ এই “শিক্ষাদান” নামক শব্দটির নামের প্রতি সুবিচার করছেন না শিক্ষকরা।

বানিজ্যে নেমেছেন তারা, কতিপয় অসাধু অতি বানিজ্য মানসিকতা সম্পন্ন শিক্ষকের জন্য সৃজনশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে সস্তা  ও নিন্মমানের নোট ও গাইড বইয়ের চাপে। মেধা খাটানোর কাজটি শিক্ষার্থীরা ভুলতে বসেছে,তাছাড়া কষ্ট করতে নারাজ শিক্ষকেরা, তারা সাময়িক পরিক্ষার প্রশ্নপত্রও কোম্পানী গুলোর কাছ থেকে এনে থাকেন। চিন্তাশক্তি থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছেন তারা দিনের পর দিন।

নাম প্রকাশনা করার শর্তে কয়েকজন সহকারী শিক্ষক তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন, আমরা কিছু বলতেও পারিনা, আবার এসব অনিয়ম সহ্য করতেও পারিনা চাকরির ভয়ে, অবস্থাএমন দাড়িয়েছে, শুধু নোট, গাইড বই বিক্রিই নয়, বই প্রকাশক কোম্পানীগুলো বিদ্যালয়ের শিক্ষাদান থেকে শুরু কওে মূল্যায়ন পত্রও তারা করে দিচ্ছেন, সৃজনশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পবিত্র সম্পর্ক থাকছেনা, আমরা দিনের পর দিন মেকানিক্যাল হয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি গোপালগঞ্জ জেলা শাখার সাধারন সম্পাদক বিকাশ চন্দ্র গোলদার বলেন, শিক্ষার্থীদেও কাছে নোট বা গাইড বই বিক্রির জন্য শিক্ষকরাই দায়ী, কিসের বিনিময়ে বা কি কারনে তারা তাদের শিক্ষার্থীদেরকে নোট বা গাইড বই কেনার জন্য বলেন, এটা তারাই ভালো বলতে পারবেন।

জেলা শিক্ষা অফিসার শেখ আকরাম হোসেন বলেন, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বই ছাড়া অন্য কোনো নোট বা গাইড বই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কে দিয়ে ক্রয় করানো অথবা তাদেরকে সেগুলো পড়ানোর কোনো সুযোগ নেই, কারো বিরুদ্ধে এর প্রমান পেলে তার বিরুদ্ধে ২ লক্ষ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।

Leave A Reply