আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

0

নিজস্ব প্রতিবেদক

আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ৬৭ বছর আগে মাতৃভাষা বাংলাকে বাঁচাতে ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বাঙালি সূর্য সন্তানেরা। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকারে জীবন উৎসর্গ করেছিল এদেশের দামাল ছেলেরা। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসের পথ ধরে আজ সারা বিশ্বে পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশের প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে জাতির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান একুশের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা/ সেই থেকে শুরু/ সেই থেকে শুরু দিনবদলের পালা।’ বাংলাদেশের মানুষ প্রথম ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে। ১৯৫২ সালের ঐক্যের ভিত্তিমূল ছিল অধিকার রক্ষা। ’৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে আত্মোৎসর্গের নজির সৃষ্টি করেছিল বাঙালি। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ঢাকার রাজপথে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, শফিউরসহ বীর সন্তানেরা। এ অমর বীরগাথা আজ কেবল এ ভূখে  সীমানায় আবদ্ধ নেই, বাঙালির আত্মত্যাগ স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত। এ গৌরব বাঙালির, বাংলাদেশের। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অহংকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের বীজ বপন হয়েছিল ভাষা আন্দোলনে। একুশের আত্মত্যাগের মাধ্যমে উন্মেষ ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের। সেই জাতীয়তাবাদী চেতনার পথ ধরে ১৯৭১-এর গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। এখনো জাতির প্রতিটি সংকট মুহূর্তের অনুপ্রেরণা একুশের চেতনা। আজও অমর একুশে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অন্তর্নিহিত শক্তি আর অদম্য সাহস হয়ে আছে। একুশ মানে মাথানত না করা। আজ একুশ এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে উন্নয়ন ও অগ্রগতির মাধ্যমে জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিতে। অমর একুশে উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পৃথক বাণীতে ভাষাশহীদদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আজ সরকারি ছুটি। আজ প্রভাতফেরি করে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে শহীদদের স্মৃতির প্রতি। সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। এ ছাড়াও রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থান ও অন্যান্য স্থানে ভাষাশহীদদের কবরে ফাতিহা পাঠ, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম প্রহরে বিনম্র শ্রদ্ধা : প্রতি বছরের মতো এবারও একুশের প্রথম প্রহরে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে জেগে উঠেছিল সারা দেশের মানুষ। একুশের প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে জাতির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান একুশের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তারা কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে মহান একুশের ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানান। এ সময় বেজে ওঠে অমর একুশের গানের করুণ সুর। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। এরপর ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা এইচ এম এরশাদের পক্ষে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র সাঈদ খোকন, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ পর্যায়ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও দূতাবাস প্রধানরা। এর আগে রাত ১১টা ৫৩ মিনিটে শহীদ মিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এ সময় মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি রাত ১১টা ৫৮ মিনিটে শহীদ মিনারে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অভ্যর্থনা জানান। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে শহীদ বেদিমূলে নিয়ে যান। তাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পরই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সাধারণের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ও ডিনগণ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নেতারা পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দল ও সংগঠন ছাড়াও ছাত্র, যুব, নারী, শ্রমিক, শিশু-কিশোর সংগঠনগুলো এবং হাজার হাজার মানুষ সারিবদ্ধভাবে একে একে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে গভীর শ্রদ্ধা জানান মহান ভাষা শহীদদের প্রতি।

সর্বস্তরের মানুষের ঢল : একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা জানানো শেষে শহীদ মিনারের বিভিন্ন পয়েন্টে সর্বস্তরের মানুষের ঢল বাড়তে থাকে। শাহবাগ মোড়, পলাশী মোড়, কাঁটাবন, নীলক্ষেত মোড়সহ শহীদ মিনারের আশপাশে সময় গড়ানোর সঙ্গে বাড়তে থাকে এ ভিড়। এ সময় ফুল নিয়ে ‘২১ মানে অহংকার’, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানসহ নানা ধরনের স্লোগান দেন শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষেরা। সমবেতভাবে ফুলের মালা নিয়ে হাঁটা লোকের সংখ্যাও ছিল অনেক।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় অন্যান্যবারের মতো এবারও শহীদ মিনারে গিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারছেন না। তবে তার পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আজ সকালে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন।

আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি : মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী পালন করবে আওয়ামী লীগ। বিএনপির দুই দিনের কর্মসূচি : মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। কর্মসূচি হলো- গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বেলা ২টায় বিএনপির উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আজ সকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে ৬টায় কালো ব্যাজ ধারণ করে নেতা-কর্মীরা রাজধানীর বলাকা সিনেমা হলের কাছে জমায়েত হয়ে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারত শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন। সারা দেশের জেলা-উপজেলা-থানাসহ বিভিন্ন ইউনিট স্থানীয়ভাবে শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও আলোচনা সভার কর্মসূচি গ্রহণ করবে।

Leave A Reply